বাংলার ভূত
কলমে : মঞ্জরী রায়
ভূতের গল্প বরাবরই বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভূতের প্রতি বিশ্বাস ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গভীরভাবে গেঁথে আছে। ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক কথিত ভূতুড়ে স্থান রয়েছে, যেমন শ্মশান, জরাজীর্ণ ভবন, রাজকীয় প্রাসাদ, দুর্গ, বনের বাংলো, শ্যাওরা গাছ ইত্যাদি… বাঙালি সংস্কৃতিতেও ভূত একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। ভূত হলও একটি অতিপ্রাকৃত সত্তা বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রূপকথার গল্পগুলি প্রায়শই ভূতের ধারণা ব্যবহার করে এবং আধুনিক দিনের বাংলা সাহিত্য, সিনেমা, রেডিও এবং টিভি প্রোগ্রামগুলিতে অলৌকিক কার্যকলাপের উল্লেখ পাওয়া যায়।পুরাতন এবং নতুন উভয় বাংলা রূপকথা এ প্রায়ই ভূতের ধারণা ব্যবহার করা হয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও প্রায়ই ভূতের উদাহরণ পাওয়া যায়। বিশ্বাস করা হয়, ভূত হল সেই সব অশরীরি আত্মা যারা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে শান্তি খুঁজে পায়নি বা পৃথিবীতে অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। ছোটবেলায়ে আমরা যতই ভয় পেতাম না কেন ভুতের, ঘুমানোর সময় আমাদের ঠাকুমা- দিদিমাদের কাছ থেকে একটি ভূতের গল্প শোনা আবশ্যক ছিল। যে কোনো বাঙালির মতো আমাদের ভূতরাও আমাদের সংস্কৃতির মতোই অনন্য । লোককাহিনী অনুসারে, যখন তারা মানুষের গন্ধ পায় তখন তারা ডাকে, ” হাউ, মৌ, খাউ…মানুষের গন্ধ পাউ।” এই কথাটি ছিল আমাদের ছোটবেলার সবচেয়ে ভয়ের বিষয়ে।
যদিও আমরা যখন ছোটবেলায়ে দাদু ঠাকুমা দের কাছ থেকে ভুতের গল্প শুনতাম ,তখন জানতাম না যে এত রকমের ভুত হয়। বড় হওয়ার পর জানলাম বাংলায়ে এত রকমের ভুত প্রচলিতও আছে। চলো আমরা দেখে নিই বিভিন্নও ধরনের বাংলা্র ভুত।
- ব্রহ্মদৈত্যঃ এধরণের ভূত সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং এরা সাধারণত কারো ক্ষতি করে না। এ ধরনের ভূতরা হলো ব্রাহ্মনের ভূত। সাধারণত এরা সাদা ধুতি ও পৈতা পরিহিত অবস্থায় বিচরণ করে। এদেরকে পবিত্র ভূত হিসেবে গণ্য করা হয়। তারা অত্যন্ত দয়ালু ও মানুষকে অনেক উপকার করে থাকে।
- পেত্নীঃ পেত্নী হলো অবিবাহিত মেয়ে ভূত যার বেঁচে থাকতে কিছু অতৃপ্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল এবং অবিবাহিতভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। পেত্নী শব্দটি সংস্কৃত প্রেতিনী শব্দ থেকে এসেছে (পুরুষবাচক শব্দ প্রেত)। এসব ভূত সাধারণত যে কোন আকৃতি ধারণ করতে পারে, এমনকি পুরুষের আকারও ধারণ করতে পারে। এরা সাধারণত বেঁচে থাকতে কোন অপরাধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে এবং মৃত্যুর পর অভিশপ্ত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করে। পেত্নীরা সাধারণত ভীষণ বদমেজাজী হয়ে থাকে এবং কাউকে আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত স্পষ্টতই মানুষের আকৃতিতে থাকে। পেত্নীদের আকৃতিতে একটিই সমস্যা রয়েছে, তা হলো তাদের পাগুলো পিছনের দিকে ঘোরানো। তাদেরকে চেনার একটিই উপায় আছে এবং সেটা হলো তাদের পা দেখে।
- শাকচুন্নিঃ শাকচুন্নি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ শঙ্খচূর্ণী থেকে এসেছে। এটা হলো হিন্দু বিবাহিত মহিলাদের ভূত, যারা বিশেষভাবে তৈরি বাঙ্গালি শুভ্র পোশাক শাড়ি পরিধান করে এবং হাতে শঙ্খ বা শাঁখা পরিধান করে। শাঁখা হলো বাঙ্গালি বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের প্রতীক। শাকচুন্নিরা সাধারনত ধনী বিবাহিতা মহিলাদের উপর ভর করে বা আক্রমণ করে যাতে করে তারা নিজেরা সেই মহিলার মত জীবন যাপন করতে পারে ও বিবাহিত জীবন উপভোগ করতে পারে। লোকগাথা অনুসারে তারা শেওড়া গাছে বসবাস করে।
- মেছোভূতঃ এ ধরণের ভূতেরা মাছ খেতে পছন্দ করে। মেছো শব্দটি বাংলা মাছ থেকে এসেছে। মেছো ভূত সাধারণত গ্রামের কোনো পুকুরপাড়ে বা জলাশয়ের ধারে, যেখানে বেশি মাছ পাওয়া যায়, সেখানে বসবাস করে। বাজার থেকে কেউ মাছ কিনে গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে ফিরলে এটি তার পিছু নেয় এবং নির্জন বাঁশঝাড়ে বা বিলের ধারে ভয় দেখিয়ে আক্রমণ করে মাছ ছিনিয়ে নেয়।
- নিশিঃ ভূতদের মধ্যে অন্যতম ভয়ংকর হলো নিশি। অন্যান্য ভূত সাধারণত নির্জন এলাকায় মানুষকে একা পেলে আক্রমণ করে। কিন্তু নিশি গভীর রাতে শিকারকে তার প্রিয় মানুষের কন্ঠে নাম ধরে ডাকে এবং বাইরে বের করে নিয়ে যায়। নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ সম্মোহিত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে; আর কখনো ফিরে আসে না। মনে করা হয় তারা নিজেরাও নিশিতে পরিণত হয়। কিছু কিছু তান্ত্রিক অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিশি পুষে থাকে। লোককাহিনী অনুসারে নিশিরা কোন মানুষকে তিনবারের বেশি ডাকতে পারে না। তাই গ্রাম বাংলায় মনে করা হয় যে কারো উচিত রাতে তিনবারের বেশী ডাকলেই ঘর থেকে বের হওয়া। এতে করে নাকি নিশির আক্রমণের ভয় থাকে না। তারা মঙ্গলবার বিকেলে এবং শনিবার সন্ধ্যায় সবচেয়ে সক্রিয় থাকার কথা।
- মামদো ভূত: হিন্দু বিশ্বাস মতে, এটি মুসলমান ব্যক্তিদের আত্মা। এদের শরীরের গঠন অন্য রকমের । কোমরের নীচ থেকে ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে গেছে। এদের কোন পা নেই এবং এরা বাতাসে ভেসে থাকে। এরা সাধারণত কবরস্থানে ও আশে-পাশে থাকা বড় ও ঘন গাছ-পালায় বসবাস করে এবং সেখান দিয়ে কেউ গেলে এরা তাদের বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখায় বলে লোককথা প্রচলিত রয়েছে।
- গেছোভূত: গেছো ভূত গাছে বসবাস করে। গেছো শব্দটি গাছ (বৃক্ষ) শব্দ থেকে এসেছে। লোকগাথা অনুসারে যেসব মানুষ গাছের ডালে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে, তাদের আত্মা সেই গাছেই থেকে যায় এবং গেছো ভূতে পরিণত হয়। বড় ও ঝাঁকালোগাছপালা এদের প্রিয় আশ্রয়স্থল। এরা বিভিন্ন ভাবে মানুষকে ভয় দেখায়। এদের সম্পর্কে অতি প্রচলিত ধারণটি হচ্ছে, রাতে যখন কোন ব্যক্তি একা পথ দিয়ে হেঁটে যায়, তখন এরা গাছে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে থাকে। ফলে সেই ব্যক্তিটি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আবার কারো কারো ভাষ্য মতে (যারা মনে করে তারা দেখেছে) এরা তালগাছ থেকে এমন ভাবে নিচে নেমে আসে যেমন করে টিকটিকি দেওয়ালে চলাফেরা করে অর্থাৎ মাথা নিচের দিকে ও পা উপরের দিকে রেখে গাছ বেয়ে নেমে আসে।
- দেও: এ ধরনের ভূত পুকুর-ডোবা, নদী এবং বিভিন্ন জলাশয়ে বসবাস করে। এরা লোকজনকে জলে ফেলে ডুবিয়ে মারে বলে বিশ্বাস করা হয়। জলাশয়ে স্নান করতে আসা মানুষদের একা পেলে এরা নীচ থেকে তাদের পা টেনে ধরে জলের গভীরে নিয়ে যায়। এতে করে সেই ব্যক্তি শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায়।
- ডাইনী: ডাইনী মূলত কোন আত্মা নয়, এরা জীবিত নারী। বাংলা লোকসাহিত্যে সাধারনত বৃদ্ধ মহিলা যার কালজাদু বা ডাকিনীবিদ্যায়ে পারদর্শী তাদেরকেই ডাইনি বলা হয়ে থাকে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, ডাইনীরা গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে তাদের হত্যা করে এবং তাদের হাড়, মাংস ও রক্ত খেয়ে ১০০ বছর বেঁচে থাকে এবং তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- স্কন্ধকাটা: এই ভূতেরা মাথাবিহীন হয়ে থাকে। সচরাচর এরা হলো সেইসব লোকের আত্মা যাদের মৃত্যুর সময় মাথা কেটে গেছে যেমন, রেল দুর্ঘটনা, হত্যা, অপঘাত, বা অন্য কোন দুর্ঘটনা। এ শ্রেণীর ভূতেরা সবসময় তাদের হারানো মাথা খুঁজে বেড়ায় এবং অন্য মানুষকে আক্রমণ করে তাদের দাসে পরিণত করে ও তার মাথা খুঁজার কাজে নিয়োগ করে।
আমাদের বাঙ্গালিদের ছোটবেলার সাথে অত্যান্ত ভাবে জরিয়ে আছে এই ভুতের গল্প। সকাল থেকে রাত অবধি আমরা ভুতের গল্প শুনে খেতাম ঘুমাতাম দুষ্টুমি করতাম। কিন্তু ভুতকে আমরা যত ই ভয়ে পাই না কেনও এই বড় হয়েও ভুতের গল্প কে আমরা ততটাই ভালোবাসি। কিন্তু বাস্তবে ভুত বলতে কোনও অস্তিত্য নাই। ভুত এবং ভুতের গল্প ছিল পুরোটাই দাদু ঠাকুমাদের কল্পনা প্রস্রুত ছোটদের কে মন ভোলানোর জন্য।