মকর সংক্রান্তি
কলমে : মঞ্জরী রায়
Picture credit : Diptajit Das
সকাল থেকে বাড়িতে হই হই কাণ্ড, এই চাল গুঁড়ি হচ্ছে, এই নারকেল কোড়া হচ্ছে, যেনও উৎসব লেগে গেছে। তিথি বাড়িতে এসে তো নিজের বাড়িকে চিনতে পারছে না। ও তাড়াতাড়ি দৌড়ে ঠাকুমার ঘরে গেলো । তিথির বয়েস সবে ৭, ও ড্রয়িং ক্লাস থেকে ফিরে এই সব দেখে অবাক। “ঠাকুমা আজ বাড়িতে কি আছে গো? মা আজ এত কিছু রান্না করছে”।“ওমা তুই জানিস না আজ ত পৌষ সাংক্রান্তি”। তিথি আগ্রহ সহকারে বলল,”পৌষ সংক্রান্তি কি গো ঠাকুমা? গতবার এরকম শীতের সময়ে পিঠে হয়েছিল না! তারপর আর সারাবছর হয়নি তো”? ঠাকুমা তিথি কে কাছে টেনে নিয়ে বললো,” আয়ে মা তোকে কিছু গল্প শোনাই বসে”।
“পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিন বাঙালিরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। তার মধ্যে পিঠা খাওয়া, ঘুড়ি উড়ানো অন্যতম। সারাদিন ঘুড়ি ওড়ানোর পরে সন্ধ্যায় বাজি ফাটিয়ে, ফানুস উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি করে।ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মকর সংক্রান্তি বা পৌষসংক্রান্তি-তে মূলত নতুন ফসলের উৎসব ‘পৌষ পার্বণ’ উদযাপিত হয়। নতুন ধান, খেজুরের গুড় এবং পাটালি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরি করা হয়, যার জন্য প্রয়োজন হয় চালের গুঁড়া, নারিকেল, দুধ আর খেজুরের গুড়। মকরসংক্রান্তি নতুন ফসলের উৎসব ছাড়াও ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘উত্তরায়ণের সূচনা হিসেবে পরিচিত। একে অশুভ সময়ের শেষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, পঞ্জিকা মতে, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়। এই দিনে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত সাগরদ্বীপে গঙ্গা সাগর (যে বিন্দু গঙ্গা নদী বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে) মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে পুণ্যস্নান ও বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সহস্রাধিক পুণ্যার্থী ও অন্যান্য রাজ্য থেকে আগত দর্শনার্থীদের সমাগম হয় এই মেলায়।
ভারতের বীরভূমের কেন্দুলী গ্রামে এই দিনটিকে ঘিরে ঐতিহ্যময় জয়দেব মেলা হয়। বাউল গান এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ। মূলত জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি ক্ষণ। ‘মকরসংক্রান্তি’ শব্দটি দিয়ে নিজ কক্ষপথ থেকে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশকে বোঝানো হয়ে থাকে। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী ‘সংক্রান্তি’ একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। ১২টি রাশি অনুযায়ী এরকম সর্বমোট ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে”।
ঠাকুমা একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে মকর সংক্রান্তি পালিত হয়। এই উৎসবটি পালিত হয় হিন্দু ধর্মীয় সূর্য দেবতা কেন্দ্র করে । সূর্যের এই তাৎপর্য বৈদিক গ্রন্থে, বিশেষ করে গায়ত্রী মন্ত্র, (হিন্দু ধর্মের একটি পবিত্র স্তোত্র) যা ঋগ্বেদ নামক ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় ।
মকর সংক্রান্তি আধ্যাত্মিক অনুশীলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং সেই অনুসারে, লোকেরা বিশেষত গঙ্গা , যমুনা , গোদাবরী , কৃষ্ণ এবং কাবেরী নদীতে পবিত্র ডুব দেয় । বিশ্বাস করা হয় যে স্নানের ফলে অতীতের পাপের পুণ্য বা পরিসমাপ্তি ঘটে। তারা সূর্যের কাছে প্রার্থনা করে এবং তাদের সাফল্য ও সমৃদ্ধির জন্য ধন্যবাদ জানায়।ভারতের বিভিন্ন অংশের হিন্দুদের মধ্যে একটি ভাগের (বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাঙালী) সাংস্কৃতিক চর্চা হল আঠালো, আবদ্ধ মিষ্টি বিশেষ করে তিল এবং নলেন গুড় এর তৈরি চিনির মিষ্টি । এই ধরণের মিষ্টি বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিদের মধ্যে স্বতন্ত্রতা এবং পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে শান্তি এবং আনন্দে একসাথে থাকার প্রতীক হিসাবে প্রতিফলিত হয়।ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে, এই সময়কালটি রবি শস্য এবং কৃষি চক্রের প্রাথমিক পর্যায়ের একটি অংশ, যেখানে ফসল বপন করা হয়েছে এবং ক্ষেতে কঠোর পরিশ্রম বেশিরভাগই শেষ। এইভাবে সময়টি সামাজিকীকরণের সময়কালকে নির্দেশ করে এবং পরিবারগুলি একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করে, গবাদি পশুর যত্ন নেয় এবং বনফায়ারের চারপাশে উদযাপন করে, মহারাষ্ট্রে ঘুড়ি উড়িয়ে উৎসবটি উদযাপন করা হয়।
মকর সংক্রান্তি হল একটি গুরুত্বপূর্ণ সমগ্র-ভারতীয় সৌর উৎসব, যা বিভিন্ন নামে পরিচিত যদিও একই তারিখে পালন করা হয়। এটি অন্ধ্র প্রদেশে পেদ্দা পান্ডুগা, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা ও মহারাষ্ট্রে মকরা সংক্রান্তি, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, আসামে মাঘ বিহু , মধ্য ও উত্তর ভারতের কিছু অংশে মাঘ মেলা, পশ্চিমে মকর সংক্রান্তি, কেরালায় মাঘরা ভালকু নামে পরিচিত, এবং অন্যান্য নামে”।
“ও ঠাকুমা আমি এত কিছু বুঝিনা। তুমি যা বললে তাতে ত মনে হচ্ছে আজ বাড়িতে পুলি পিঠে , সরুচাকুলি, আশকে পিঠে হবে”।তিথি অনেকখন পর বলে উঠল।
“হ্যাঁ রে পাগলি! তুই খাবি না?” ঠাকুমা হেঁসে উঠল।
“হ্যাঁ হ্যাঁ”।তিথি নাচতে নাচতে দৌড় দিল মায়ের কাছে, পাছে ওর ভাগের পিঠে চুরি হয়ে যায়ে।
আপনার লেখা এত সহজ সরল অনায়াস। আপনার সব লেখা পড়ার ইচছা রইল। ।